ওপেনসোর্স হার্ডওয়্যার : আরডুইনো আরডুইনো’র তৈরি কিছু প্রজেক্ট ।

ড. মশিউর রহমান
আপনারা ওপেনসোর্স সফটওয়্যারের কথা শুনেছেন হয়তো, কিন্তু ওপেনসোর্স হার্ডওয়্যারের কথা হয়তো নতুন শোনাবে আপনাদের কাছে। আজকে এই নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব আপনাদের।
আমরা যেসব ইলেকট্রনিক পণ্য ব্যবহার করি, সেগুলোকে আমরা হার্ডওয়্যার বলি। এসব হার্ডওয়্যার বিভিন্ন ইলেকট্রনিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করে এবং এর ডিজাইনও সেই প্রতিষ্ঠানের তৈরি করা। একটি সাধারণ ইলেকট্রনিকের যন্ত্র অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ দিয়ে তৈরি এবং সেই ক্ষুদ্র অংশগুলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরি করে। আপনি যদি একটি ইলেকট্রনিকের যন্ত্র খুলে দেখেন তবে দেখতে পাবেন সেখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অংশ রয়েছে। মনে করা যাক, আপনার হাতের মোবাইলটি খুললেন। সেখানে দেখতে পাবেন স্ক্রিনটি তৈরি করেছে একটি প্রতিষ্ঠান, আবার বিভিন্ন প্রসেসরগুলো তৈরি করেছে বিভিন্ন কোম্পানি। এভাবে অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের হার্ডওয়্যার দিয়ে আপনার মোবাইলটি তৈরি। এসব হার্ডওয়্যারের ওপর কাজ করছে সফটওয়্যার, যা এসব হার্ডওয়্যারের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে। কোনো প্রতিষ্ঠানের হার্ডওয়্যার ডিজাইনের ওপর নির্ভর না করে সবাই মিলে একটি স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলে হার্ডওয়্যারের ডিজাইন করাকেই ওপেন সোর্স হার্ডওয়্যার বলে। ওপেন সোর্স সফটওয়্যারের মতোই এটির ডিজাইন ও সোর্স সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। যে কেউ এই স্ট্যান্ডার্ডগুলো মেনে হার্ডওয়্যার তৈরি করতে পারে এবং বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করতে পারে।

উন্মুক্ত কেন?
যারা হার্ডওয়্যার নিয়ে কাজ করেন বা সিস্টেম তৈরি করেন তাদের হার্ডওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার বলে। হার্ডওয়্যার ইঞ্জিনিয়াররা যখন একটি সিস্টেম তৈরি করতে বসেন বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের হার্ডওয়্যার ব্যবহার করেন তখন বেশ সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। হার্ডওয়্যারটি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর অনেক ক্ষেত্রে নির্ভর করতে হয় ইঞ্জিনিয়ারদের। দেখা গেল, যিনি তৈরি করবেন তিনি ব্যবহার করে পাইথন প্রোগ্রামিং ভাষা কিন্তু যে হার্ডওয়্যারটি ব্যবহার করছেন তার জন্য পাইথনের লাইব্রেরি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান দেয়নি। সেক্ষেত্রে দেখা যায়—প্রকৌশলীকে পুনরায় সেই হার্ডওয়্যারটিকে হ্যাক করতে হয়। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য সবাই এখন উন্মুক্ত ডিজাইনের কথা ভাবছে। ফলে খুব সহজেই প্রযুক্তিবিদ সেই হার্ডওয়্যারটি ব্যবহার করতে পারবেন। আবার হার্ডওয়্যার প্রস্তুতকারকদের ডিজাইন করা সহজ হয়ে যাবে। তবে অনেকে ভাবছেন, যেসব হার্ডওয়্যার প্রস্তুতকারী এতদিন ধরে বিভিন্ন ডিজাইনের হার্ডওয়্যার তৈরি করেছেন এবং অনেক কারিগরি সমস্যার সমাধান করেছেন তারা খুব সহজে তাদের ডিজাইন উন্মুক্ত করবেন না।

তৈরি হয়েছে আরডুইনো
যদিও উন্মুক্ত হার্ডওয়্যারের ধারণাটি বড় বড় হার্ডওয়্যার প্রস্তুতকারক এখনও গ্রহণ করেনি, তবুও এর যাত্রা শুরু হয়েছে। এমন একটি উন্মুক্ত হার্ডওয়্যারের ধারণার ওপর

তৈরি হয়েছে আরডুইনো। আরডুইনো ব্যবহার করে খুব সহজে ইলেকট্রনিকের যন্ত্রপাতি থেকে তথ্য কম্পিউটারে প্রবেশ করানো ও ফিডব্যাক দেয়া সম্ভব।

আরডুইনো কী?
সাধারণ মাইক্রোকন্ট্রোলার বোর্ড ব্যবহার করে আরডুইনো একটি ওপেন সোর্স কম্পিউটিং প্লাটফর্ম, যা খুব সহজে বোর্ডের জন্য সফটওয়্যার লিখতে সাহায্য করে। এটি ব্যবহার করে সহজে অবজেক্ট তৈরি করা সম্ভব, যা দিয়ে বিভিন্ন সুইচ ও সেন্সর থেকে তথ্য গ্রহণ করা এবং বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি (যেমন লাইট, মোটর) নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আরডুইনো কম্পিউটার দিয়েও নিয়ন্ত্রণ করা যায়, আবার কম্পিউটারবিহীন বোর্ডেই প্রোগ্রামটি চালু করা সম্ভব। আরডুইনো একটি ওপেন সোর্স আর্কিটেক্ট। তাই এটি ইচ্ছে করলে আপনি ব্যবহার করে নিজেই যন্ত্রপাতি তৈরি করতে পারবেন। আবার ইচ্ছে করলে বিভিন্ন কোম্পানি যারা আরডুইনোর আর্কিটেক্ট মেনে তৈরি করে সেগুলো ব্যবহার করতে পারবেন। আর ওপেন সোর্স আরডুইনো আইডিই ডাউনলোড করে খুব সহজে সফটওয়্যার তৈরি করতে পারবেন। আরডুইনো অঞগঊএঅ৮ ও অঞগঊএঅ১৬৮ মাইক্রোকন্ট্রোলার ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে।

আরডুইনোর সুবিধাগুলো
—আরডুইনো যে কোনো কম্পিউটার দিয়ে চালনা করা সম্ভব। আপনি উইন্ডোজ, ম্যাক কিংবা লিনাক্স ব্যবহারকারী হোন না কেন, খুব সহজেই আপনার কম্পিউটার দিয়ে আরডুইনোর মেশিন নিয়ন্ত্রণ করার সফটওয়্যার তৈরি করতে পারবেন। এর ভেতরের গঠন জাভার মতো।
—বিভিন্ন প্রোগ্রামিং ভাষা দিয়ে সহজে কাজ করা যায়।
—বিশ্বের অনেক ইলেকট্রনিক যন্ত্র তৈরির কোম্পানিগুলো আরডুইনো ভিত্তি করে ইলেকট্রনিক যন্ত্র তৈরি করছে।
উন্মুক্ত হার্ডওয়্যারের ধারণাটি মাত্র যাত্রা শুরু করেছে। তবে উন্মুক্ত সফটওয়্যার থেকে এর ভিন্নতা হলো এর বিজনেস মডেলটি একটু ভিন্ন। যেহেতু এটি দিয়ে হার্ডওয়্যার তৈরি করতে হয় এবং এটি তৈরি করতে অনেক শ্রম ও অর্থের প্রয়োজন, তাই এটিকে ভালো লাভজনক বিজনেস মডেলে রূপান্তর করতে হয়, যা উন্মুক্ত হয়েও চ্যালেঞ্জিং। তাই উন্মুক্ত হার্ডওয়্যারের ভবিষ্যত্ বলবে এটি উন্মুক্ত সফটওয়্যারের মতো কতটুকু প্রযুক্তিবিদদের সাড়া দেবে।

বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনা
বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মূল পাঠের পাশাপাশি হাতেনাতে ইলেকট্রনিকের যন্ত্র তৈরি করার জন্য আমরা আরডুইনো বা উন্মুক্ত হার্ডওয়্যার ব্যবহার করতে পারি। উন্মুক্ত হওয়ার কারণে এটি শিখে ভবিষ্যতের প্রকৌশলীদের জন্য ক্যারিয়ারেও সহায়তা করে। উন্মুক্ত হার্ডওয়্যার ব্যবহার করে বাংলাদেশে বসেও আমাদের প্রকৌশলীরা বিশ্বের প্রজেক্টগুলোতে কাজ করে অর্থ উপার্জন করতে পারে। বাংলাদেশের হার্ডওয়্যার প্রস্তুতের প্রতিষ্ঠান আমরা গড়ে তুলতে পারি এবং সারা বিশ্বে তা সরবরাহ করতে পারি। উল্লেখ্য, বর্তমানে আমি উন্মুক্ত হার্ডওয়্যার ব্যবহার করে বায়োটেকনোলজির বৈজ্ঞানিকদের জন্য বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরি করছি। যেহেতু এর ডিজাইনগুলো উন্মুক্ত তাই এটি দিয়ে খুব সহজেই বিভিন্ন প্রোগ্রামিং ভাষা ব্যবহার করে সফটওয়্যার তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার যন্ত্রপাতি তৈরি করার ক্ষেত্রে ল্যাবভিউ, পাইথন ও সি-প্রোগ্রামিং ভাষা ব্যবহার করি।
উন্মুক্ত সফটওয়্যারের মতোই উন্মুক্ত হার্ডওয়্যারও ভবিষ্যতে অপার সম্ভাবনা বলে আমরা এর ব্যবহারকারীরা মনে করছি। বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক নিয়ে কাজ করা প্রকৌশলীরা এই উন্মুক্ত হার্ডওয়্যার ব্যবহার করে দেখতে পারেন।
লেখক : বৈজ্ঞানিক
এজেন্সি ফর সায়েন্স, টেকনোলজি অ্যান্ড রিসার্চ (A*STAR), সিঙ্গাপুর।
http://biggani.com এর প্রতিষ্ঠাতা।

Leave a comment